সড়ক যেন মৃত্যুপুরী, উৎসব রূপ নিচ্ছে বিষাদে

Passenger Voice    |    ১১:০৭ এএম, ২০২৪-০৪-২৯


সড়ক যেন মৃত্যুপুরী, উৎসব রূপ নিচ্ছে বিষাদে

ঈদ কেন্দ্র করে প্রতি বছর গ্রামে ফেরে লাখো মানুষ। কর্মব্যস্ততা আর যান্ত্রিকতা ফেলে মানুষ চায় স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে। এজন্য যে যেভাবে পারে, বাড়ি ফিরতে চায়। তবে তুমুল আনন্দ নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয় না অনেকের। দুর্ঘটনায় সড়কেই ঝরে যায় প্রাণ। পরিবারগুলোতে নেমে আসে শোকের ছায়া। মহাসড়ক যেন হয়ে ওঠে মৃত্যুপুরী। উৎসবগুলো রূপ নেয় বিষাদে।

গত কয়েক বছরের তুলনায় সড়কের উন্নয়ন হয়েছে এবার। ঈদযাত্রায় ভোগান্তি ছিল তুলনামূলক কম। রাস্তায় খানাখন্দ কিংবা দীর্ঘ যানজট না থাকায় যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরতে পেরেছেন। তবে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বেড়েছে। সরকারি-বেসরকারি কয়েকটি সংস্থার প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

এ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সড়কের উন্নয়ন করে দুর্ঘটনা রোধ করা বা কমানো সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ আর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেটি করা না গেলে সড়ক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন হলেও দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়।

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। কয়েকটি সংগঠন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সমন্বয় করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে গণমাধ্যমে সব দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ না হওয়ায় অনেক দুর্ঘটনার তথ্য অন্তরালেই থেকে যায়।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) দেওয়া ঈদকেন্দ্রিক সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য মতে, দেশে ঈদের আগে-পরে ১৭ দিনে সব মিলিয়ে ২৮৬টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩২০ জন নিহত ও ৪৬২ জন আহত হয়েছেন। এসময়ে গড়ে প্রতিদিন ১৭টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। প্রতিদিন গড়ে ১৯ জন নিহত ও ২৭ জন আহত হয়েছেন।

গত বছরের (২০২৩) তুলনায় এবার ঈদুল ফিতরে গড় দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়েনি। তবে গড় নিহতের সংখ্যা প্রায় তিনজন বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের তুলনায় এবার নিহত বেড়েছে গড়ে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।

সরকারি এ সংস্থাটির তথ্য বলছে, ঈদে ঢাকা বিভাগে ৫৮ দুর্ঘটনায় ৭৩ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৭ দুর্ঘটনায় ৪৭, রাজশাহী বিভাগে ৩৮ দুর্ঘটনায় ৪৩, খুলনায় ২৯ দুর্ঘটনায় ৩১, বরিশালে ২৫ দুর্ঘটনায় ৩৪, সিলেটে ১৪ দুর্ঘটনায় ১৭, রংপুরে ১৯ দুর্ঘটনায় ২০ ও ময়মনসিংহে ২৪ দুর্ঘটনায় ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সড়ক দুর্ঘটনা মনিটরিং সেলের প্রতিবেদন বলছে, ঈদযাত্রা শুরুর দিন অর্থাৎ ৪ এপ্রিল থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা অর্থাৎ ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪০৭ জন নিহত ও ১৩৯৮ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে রেলপথে ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত ও ২১ জন আহত হয়েছেন। নৌপথে দুটি দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত ও পাঁচজন আহত হয়েছেন। সব মিলিয়ে সড়ক, রেল ও নৌপথে সর্বমোট ৪১৯টি দুর্ঘটনায় ৪৩৮ জন নিহত ও ১ হাজার ৪২৪ জন আহত হয়েছেন।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, এবারের ঈদে লম্বা ছুটি থাকায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২০ শতাংশ মানুষের বেশি যাতায়াত হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে ৩০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৮ জন নিহত ও ৫৬৫ জন আহত হয়েছিলেন। তুলনায় দেখা যায়, এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ৩১.২৫ শতাংশ, প্রাণহানি ২৪.০৮ শতাংশ ও আহত ১৪৭.৪৩ শতাংশ বেড়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যম এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে এক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সেই প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এবার ঈদের আগে ও পরে ১৫ দিনে (৪ থেকে ১৮ এপ্রিল) দেশে ৩৫৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৬৭ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ঈদকেন্দ্রিক গত ছয় বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে ঈদযাত্রার ১৪ দিনে ১৪৬টি দুর্ঘটনায় ১৯৪ জন নিহত এবং ৪০২ জন আহত হন। ২০২০ সালের ১২ দিনে ১২৮টি দুর্ঘটনায় ১৪৭ জন নিহত এবং ৩১৮ জন আহত হন। ২০২১ সালে ১৪ দিনে ২৩৯টি দুর্ঘটনায় ৩১৪ জন নিহত এবং ২৯১ জন আহত, ২০২২ সালে ১৪ দিনে ২৮৩ দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জন নিহত এবং ১ হাজার ৮০০ জন আহত এবং ২০২৩ সালে ১৪ দিনে ২৪০টি দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত এবং ৪৫৪ জন আহত হন। এ বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ১৫ দিনে ৩৫৮ দুর্ঘটনায় ৩৬২ জন নিহত এবং ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি আহত হন।

এবারের ঈদযাত্রায় বড় দুটি দুর্ঘটনা ঘটে ফরিদপুর ও ঝালকাঠিতে। গত ১৬ এপ্রিল ফরিদপুরের কানাইপুরে বাস ও পিকআপভ্যানের সংঘর্ষে ১৬ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে ১৭ এপ্রিল ঝালকাঠির গাবখান সেতুর টোলপ্লাজায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিমেন্টবাহী একটি ট্রাকের ধাক্কায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গাড়ির আরও ১৪ আরোহী নিহত হন। এ দুটি দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।

সড়কে দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যগত অমিলের বিষয়ে জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কষ্টকর। বেসরকারিভাবে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা সম্ভব নয়। গণমাধ্যমে সব দুর্ঘটনার তথ্য আসে না। আবার হাসপাতালে সব তথ্য পাওয়া যায় না। পুলিশও সেভাবে সব তথ্য দিতে পারে না। ফলে প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হয় না। তবে সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা নিয়ে আমরা ধারণা পেতে পারি। সরকার যদি উদ্যোগ নেয় তাহলে সবার সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত চিত্র উপস্থাপন করা যেতে পারে। এতে জনগণ বিভ্রান্ত হবে না। বেসরকারি পর্যায়ে এটি করা কষ্টকর।

সড়ক দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের দেশে দক্ষ চালকের অভাব রয়েছে। চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। এছাড়া তাদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করে দেওয়া প্রয়োজন। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দরকার। মহাসড়কে থ্রি-হুইলার, নছিমন-করিমন, ইজিবাইকের চলাচল বন্ধ করা দরকার। মোটরসাইকেল চলাচল নিরুৎসাহিত করে গণপরিবহনের ব্যবস্থা উন্নত করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমে আসবে।

এ নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ সড়ক ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্রযুক্তি চালু করা জরুরি। বিশ্বের অনেক দেশ রাস্তা থেকে আনফিট গাড়ি সরাতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে আমরা কেন পারছি না? আমরা লক্ষ্য করছি, পরিবহনের নেতা ও আমলাদের গতানুগতিক সিদ্ধান্তেই ঘুরপাক খাচ্ছি। দাবি, সুপারিশমালা- এগুলোই চলছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্বের অন্য দেশ যেভাবে সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সক্ষম হয়েছে, আমাদের দেশেও সেই পন্থা অবলম্বন করা জরুরি।

যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের কথা বলছি, স্মার্ট সড়ক অবশ্যই লাগবে। তবে সড়ক উন্নত আর স্মার্ট হলেও যানবাহন স্মার্ট হয়নি, চালকদের আমরা স্মার্ট করতে পারিনি, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাও স্মার্ট হয়নি। পাশাপাশি মহাসড়ক বা এক্সপ্রেসওয়ের পাশে থাকা ভূমির আমরা স্মার্ট ব্যবস্থাপনা করতে পারিনি। দুর্ঘটনার যে ঝুঁকিগুলো রয়েছে, সব রেখেই আমরা গাড়ির গতি বাড়াচ্ছি। আমরা শুধু সড়কগুলো প্রশস্ত করছি। দুই লেন থেকে চার লেন, চার লেন থেকে আট লেন করছি। কিন্তু সড়ক প্রশস্ত করে পৃথিবীর কেউ দুর্ঘটনা কমাতে পারেনি, পারবেও না।

বাংলাদেশে ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেটি আমরা অর্জন করতে পারিনি। এটি আবার রিভাইজ করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সড়কের উন্নয়ন হলো পাঁচ শতাংশ, যেটি বিজ্ঞানভিত্তিক। বাকি ৯৫ শতাংশ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। এটা কোনো টেকনিক্যাল সমস্যা নয়, এটা রাজনৈতিক সমস্যা।

সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে হলে বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধানের পাশাপাশি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি, উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া না গেলে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না।

ঈদে গণপরিবহন সংকটে সরকার চাইলেই সৃজনশীল উদ্যোগ নিয়ে সংকটের সমাধান করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঈদে দুর্ঘটনায় বেশিরভাগই শ্রমজীবী বা নিম্ন আয়ের মানুষ মারা যায়। তারা বাধ্য হয়ে ট্রেনের ছাদে, বাসের ছাদে ভ্রমণ করেন। ঢাকায় অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব বাস রয়েছে। এগুলো আমরা ঈদযাত্রায় ব্যবহার করতে পারি। প্রয়োজনে একটা প্রোগ্রামের আওতায় একমাস আগেই বুকিং সিস্টেম চালু করা যেতে পারে যে, কারা কারা এই সার্ভিসের আওতায় কোন কোন জেলায় যেতে চায়। এসব বাসচালকরা যথেষ্ট দক্ষ। তাহলে সংকটের কিছুটা হলেও সমাধান হবে। সূত্র: জাগো নিউজ

প্যা/ভ/ম